আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের পূর্বকথা
ইউরোপীয়
ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ৭০টি দেশে বসবাসকারী প্রায় ৪০ কোটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উপর চলমান শতাব্দী ব্যাপী বৈষম্য ও জাতিগত আগ্রাসন জাতিসংঘ স্বীকার করেছে। ১৯২৩ সালে কানাডার হৌদেনসোনি প্রধান দেসকাহেহ্ সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে সফর করেন তৎকালীন জাতিপুঞ্জের কথা বলার জন্য এবং তাঁর স্বজাতির লোকেরা যাতে তাদের আইনানুসারে, তাদের নিজস্ব আবাসভূমিতে এবং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী বসবাস করতে পারে সেই অধিকারের কথা তুলে ধরতে। কিন্তু তাঁকে জাতিপুঞ্জে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। এমনকি তাঁকে ১৯২৪ সালে তাঁর দেশে (আবাসভূমিতে) ফিরতেও দেয়া হয় নি। যদিও তিনি সেসময় জাতিপুঞ্জে কথা বলতে পারেনি, কিন্তু তাঁর সেই লক্ষ্য ও স্বপ্ন পরবর্তী প্রজন্মকে প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল যা আজো অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
১৯৭০
সালে জাতিসংঘের সংখ্যালঘু রক্ষা ও বৈষম্য প্রতিরোধ সংক্রান্ত উপ-কমিশন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত পরিস্থিতির উপর এক সামগ্রিক পর্যালোচনা শুরু করার সুপারিশ গ্রহণ করে। উক্ত সুপারিশ অনুসারে ১৯৭১ সালে মি. হোজে মার্টিনেজ কোবো’কে এ বিষয়ে গবেষণার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দীর্ঘ ১২ বছর ধরে গবেষণার পর ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যের সমস্যাবলীর গবেষণাকর্ম’ শিরোনামে ২২টি অধ্যায় বিশিষ্ট ১৪০০ পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন। উক্ত প্রতিবেদনে যে সকল সুপারিশ গ্রহণ করা হয় তন্মধ্যে অন্যতম ছিল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সম্বলিত একটি আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা।
উক্ত
সুপারিশমূলে ‘সংখ্যালঘু রক্ষা ও বৈষম্য প্রতিরোধ সংক্রান্ত উপ-কমিটি’ (পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে ‘মানবাধিকার বিষয়ক উপ-কমিশন’ করা হয়) কর্তৃক ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ’ ১৯৮২ সালে স্থাপন করে । মি. হোজে মার্টিনেজ কোবো’র পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালা অনুসারে উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত পরিস্থিতির উপর এক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা শুরু করে।
জাতিংঘের
সদস্য রাষ্ট্র ও আদিবাসী প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৯৮৫ হতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আলোচনা-পর্যালোচনার উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ কর্তৃক ৪৬টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’-এর একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয় এবং তা ১৯৯৪ সালে মানবাধিকার উপ-কমিশনে পেশ করা হয়। উপ-কমিশনে উক্ত খসড়া ঘোষণাপত্রে অনুমোদনপূর্বক মানবাধিকার কমিশনে প্রেরণ করে।
ইতিমধ্যেই
জাতিংঘ ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ এবং ৯ই আগষ্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অপরদিকে ১৯৯৩ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৫-২০০৪ সাল’কে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। উক্ত দশকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল ঘোষিত দশকের মধ্যে ’আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করা। তারই ধারাবাহিকতায় উক্ত খসড়া ঘোষণাপত্রের বিস্তৃত ও দফাওয়ারী পরীক্ষা-নিরীক্ষার লক্ষ্যে
মানবাধিকার
কমিশন ১৯৯৫ সালে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ’ স্থাপন করে।
১৯৯৫
সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রত্যেক বছর আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও এনজিও প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণসহ ঘোষণাপত্র পর্যালোচনার নিয়মিত অধিবেশন বসে, কিন্তু খসড়া ঘোষণাপত্রের চূড়ান্তকরণের নিমিত্তে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ ব্যর্থ হয়। সর্বসম্মত ঐক্যমত্যে উপনীত না হওয়ার পেছনে মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, আদিবাসীদের ‘Peoples’ হিসেবে আখ্যায়িত করা, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সমষ্টিগত অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে মতানৈক্য।
২০০৫
সালের ২০ এপ্রিল মানবাধিকার কমিশন ‘ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এবং ’আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এই দুটি ওয়ার্কিং গ্রুপের কাজ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর চেয়ারম্যান লুইস এনরিক চেভেজ (পেরু’র নাগরিক) খসড়া ঘোষণাপত্রের বিতর্কিত অনুচ্ছেদগুলো সংশোধনপূর্বক মতৈক্যমূলক শব্দ সন্নিবেশ করে মানবাধিকার কমিশনে পেশ করে।
এরপর
২৯ জুন ২০০৬ সালে ‘মানবাধিকার কমিশন’-এর পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত ‘মানবাধিকার পরিষদ’ ইহার উদ্বোধনী অধিবেশনে পক্ষে ৩০ ভোট, বিপক্ষে ২ ভোট ও অনুপস্থিত ১২ ভোটে উক্ত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে এবং সাথে সাথে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর উক্ত খসড়া ঘোষণাপত্র সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে নামিবিয়া উক্ত ঘোষণাপত্রের উপর সাধারণ পরিষদের ভোট গ্রহণ পিছিয়ে নেয়ার প্রস্তাব পেশ করে। পক্ষে ৮২ ভোট, বিপক্ষে ৬৭ ভোট ও অনুপস্থিত ২৪ ভোটে এই কমিটি উক্ত প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং এর ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদও তৃতীয় কমিটির প্রস্তাবানুসারে খসড়া ঘোষণাপত্রের উপর ভোট গ্রহণ স্থগিত করে। এর ফলে সাধারণ পরিষদের ভোট গ্রহণ পরবর্তী ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়।
অবশেষে
২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে পক্ষে ১৪৩ ভোট, বিপক্ষে ৪ ভোট ও অনুপস্থিত ১১ ভোটে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক এই ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। সাধারণ পরিষদ কর্তৃক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আড়াই দশকের কর্মপ্রচেষ্টার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র নিঃসন্দেহে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি মাইলফলক।
No comments:
Post a Comment