Saturday, August 06, 2022

আদিবাসী, ভূমি ও জীবন

আদিবাসীদের কাছে ভূমিই জীবন, ভূমিই অস্তিত্ব। আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কিছু বলার আগে, সম্পদ, ভূমি, বন, প্রাণী জগত, ধরিত্রী ও অধিকার সম্পর্কে আদিবাসী মানুষের বৈশিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, সে বিষয়টি ভেবে দেখা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বজুড়ে ভূমির সঙ্গে আদিবাসীদের সম্পর্ক যে শুধু অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক নয়, ভূমির সঙ্গে আদিবাসীদের যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, তা আদিবাসী এক প্রবীণ নেতার বক্তব্যে ফুটে উঠেছে যে বক্তব্য জাতিসংঘ ব্যবহার করেছে। জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম Indigenous Peoples, Indigenous Voices শিরোনামের বইটি ২০০৩ সালের মে মাসে প্রকাশ করেছে United Nations Department of Public Information - DPI / 2309,  বইয়ে লেখা আছে,
Land is the generation point of existence,,,
It is a living place
Made up of sky, clouds, rivers, trees, the wind, the sand,
and the spirit there - it is my own country ..
It is a living entity.
It belongs to me.
I belong to the land,
I rest in it,
I come from here.

-Bill Nedji, Elder
Northern Territory, Australia

অস্ট্রেলিয়ার  নর্দান টেরিটরির প্রবীণ এই নেতার বক্তব্য বাংলায় রূপান্তর করলে এরকম হতে পারে, “ভূমিই আদিবাসীদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। ভূমি আমাদের ঠিকানা। ভূমি জীবনের প্রতীক। এই ভূমি আমাদের, আমরাও ভূমির। ভূমিতে আমরা বিশ্রাম নিই। আমরা ভূমি থেকে আসি, আবার ভূমিতে ফিরে যাই।”
বিশ্বজুড়ে ভূমি আদিবাসীদের কাছে পবিত্র। আদিবাসী সংস্কৃতিতে ভূমি হলো জননী। ধরিত্রীও জননী। আদিবাসীরা প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারে। তারা বনকে কোনোদিন বেচাকেনার বিষয় হিসেবে দেখে না, জীবনের অংশ হিসেবে দেখে। আর আধুনিক সভ্যতা বন, সম্পদ, প্রকৃতি সবকিছু বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখে। এখানেই আদিবাসীদের সঙ্গে বর্তমান উন্নয়ন ধারার সমস্যা।

একসময় আদিবাসী জীবনে সবকিছু অলিখিত। মুখে  মুখে চলে আসা ওরাল সংস্কৃতি। আইনকানুন ছিল মুখে মুখে, প্রথাগত ও ট্রাডিশনাল। তাদের লিটারেচারও ছিল ওরাল। আদিকালে জীবন ছিল যূথবদ্ধ। তখন বন ও ভূমির উপর ছিল মানুষের ঐতিহ্যগত স্বত:সিদ্ধ অধিকার। প্রথাগত সব অধিকার। তখন জনসংখ্যা কম ছিল। অবারিত ছিল বন ও ভূমিতে মানুষের বিচরণ। আদিবাসী জীবনের সাথে মূলস্রোতের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনায় ম্যাগসেসে পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্রখ্যাত লেখক মহাশ্বেতা দেবী তার টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা উপন্যাসে আদিবাসীদের কথা এভাবে লিখেছেন, “শোষণ” শব্দ তো হো ভাষায় নেই। যাদের জীবনে শুধুই শোষণ, শুধু বঞ্চনা, সেই আদিবাসীদের কোনো ভাষাতেই কি আছে ”শোষণ” শব্দের সমার্থক শব্দ? .... এক সময় বন ছিল, পাহাড় ছিল, নদী ছিল, আমরা ছিলাম। আমাদের গ্রাম ছিল, ঘর ছিল, জমি ছিল, আমরা ছিলাম।
এ কথাগুলোর মধ্যে আদিবাসীদের দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা স্বপ্ন উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়া সব জড়িয়ে আছে। ভারতবর্ষ শুধু নয়, বিশ্বের ৯০টি দেশের ৪০ কোটি আদিবাসী মানুষের জন্য এই কথাটি প্রযোজ্য। জাতিসংঘ আদিবাসদের এই ধরনের ঐতিহাসিক শোষণ ও বঞ্চনার কারণেই ২০০০ সালে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অধীনে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠণ করেছে এবং জাতিসংঘ স্বীকার করেছে বিশ্বব্যাপী ঐতিহাসিকভাবে আদিবাসী জনগণ নানামুখী শোষণ ও বৈষম্যের কারণে তাদের আত্ম-পরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি ও মৌলিক মানবাধিকার হারাতে বসেছে।

তাই আদিবাসী অধিকার বুঝতে হলে ওদের মনস্তত্ত্বকে, বৈশ্বিক ও জীবন ভাবনার বিশ্বজনীনতাকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে, গায়ের জোরে, ক্ষমতা ও শক্তির দাপটে নয়। ওদের জীবনে বহিরাগতরা প্রবল রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে ঢুকে গেছে আর সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের মতো চলে গেছে সব জমি, বন, পাহাড়, প্রাকৃতিক সম্পদ। ওরা এখন অধিকারহীন অসহায় মানুষ। অতি সংবেদনশীল, বিনম্র শ্রদ্ধা, প্রচন্ড ভালোবাসা ছাড়া আদিবাসাীদের উন্নয়ন ও রক্ষা করা সম্ভব নয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবখানে আদিবাসী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতার প্রতিফলন দরকার। এই প্রান্তিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ। দেশে আদিবাসী অধিকার রক্ষার জন্য আইন ও নীতিমালা থাকা দরকার।
১৯৬০ সালে এপ্রিল মাসে ভারতীয় সংবিধান মতে, শিডিউলড এরিয়াজ শিডিউলড ট্রাইবস কমিশন গঠিত হয়। ওই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, “The Fundamentals on An Approach to the Tribes" যার মূল বক্তব্য ছিল “ট্রাইবাল টাচ” বা ”আদিবাসীদের প্রতি পক্ষপাত”। এর অর্থ হলো, আদিবাসীদের চোখ দিয়ে, ওদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সব কিছু দেখার চেষ্টা করা। তারপর থেকে আদিবাসী অঞ্চল বা ব্লকগুলোতে অর্থ বরাদ্দ গেল। এই কমিটির এক সদস্য পরবর্তীতে লিখেন, প্রতিটি মানব তার ভাইয়ের দায়িত্ব বহন করবে আদিবাসীদের বিষয়ে। আমাদের দীর্ঘ অবহেলা, আমাদের ভূল দৃষ্টিভঙ্গি - এর প্রায়শ্চিত্ত আমাদের সকলকে করতেই হবে। জগতে একটি মানবজাতি, এবং আদিবাসীরা সে জাতির অতীব অমূল্য এক অঙ্গ।
আদিবাসী জীবন অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ। এই সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ে শ্রমজীবি খেটে খাওয়া মানুষ। তারা আজো তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায় ্এবং সফল পরিবর্তনের দিকে এগুতে চায়। আদিবাসী সংস্কৃতি যাতে ধ্বংস না হয়, তার পদক্ষেপ রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আদিবাসী বান্ধব একটি জাতীয় পলিসি দরকার। আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে ভারতে আদিবাসী কমিশন হয়েছিল ১৯৬০ সালে। তখন মুক্ত ভারতের বয়স মাত্র ১২/১৩ বছর। আর আমরা প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত করছি স্বাধীনতার। আমরা কত পিছিয়ে আছি। আদিবাসী বিষয়ে একটি কমিশন হোক, তারা রিপোর্ট করুক, দেশের ৩০ লক্ষ আদিবাসীদের মানবিক মর্যাদা ও উন্নয়নের জন্য। অসীম নম্রতা ও হৃদয়ভরা আন্তরিকতায় লেখা হবে সে রিপোর্ট, এইরকম স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে।

মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন, ভারতের সংবিধানে লেখা আছে, “এই সকল ট্রাইব ও আদিবাসীর সংখ্যা ত্রিশ মিলিয়ন। .....They should be made to enjoy the privileges of citizenship and should be able to take part in the making and strengthening the democratic institutions in the country. They should enjoy the fruits of liberty, equality and fraternity.  কার্যকালে দশকের পর দশক ধরে শব্দগুলি সংবিধানের শোভা হয়ে থাকে এবং আদিবাসীদের দুঃখ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার দপ্তর থেকে হতাশা নিয়ে ফিরে এসে আদিবাসীরা স্টেশনে উবু হয়ে বসে থাকে, ট্রেন ধরে, সাঁইত্রিশ লক্ষ মাইল হেঁটে গ্রামে ফেরে এবং অপরিচিত, হিংস্র আলোকজ্জ্বল নয়া ভারত থেকে স্বীয় পরিবেশের অপরিমেয় অন্ধকারে ফিরে স্বস্তি পায়। সে কারণেই ওরা বাইরের সব কিছুকে অবিশ্বাস করে। কিন্তু আদিবাসী অরণ্য জীবনে বহিরাগতের Encroachment  অনিবার্য। ওরা জানে, দিকু, মহাজন, জোতদার, নকশালি বা জেপি পন্থি সন্ধানী পুলিশ ওদের জীবনে ঢুকবে, ঢুকে গেছে। ওরা বিশ্বাস করতে পারে তাকেই, যে দারিদ্র্যে ও শোষণে ওদের সমগোত্রীয়। - মহাশ্বেতা দেবী গল্প, জগমোহনের মৃত্যু।
তাই রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে শুধু আইন দিয়ে, সংবিধানের কথা বলে আদিবাসীদের এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। ওদের আলাদা জগত ও বৈচিত্র্যকে সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে হবে। আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকতে হবে। আদিবাসীদের  উন্নয়নের জন্য মানবাধিকারকে অগ্রধিকার দিতে হবে।আদিবাসীদের মনে যেন এই ধারনা না জন্মায়, ওরা অন্যের দ্বারা শাসিত হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী ওদের শাসন করছে। এই কাজটি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং মূল দায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের। সবকিছুর জন্য দরকার আদিবাসীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলাপ আলোচনা ও ইতিবাচক মর্যাদাপূর্ণ সংলাপ। আদিবাসীদের আস্থায় এনে এ কাজটি করতে হবে। আদিবাসীদেরকেও সহযোগীতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ভেরিয়ার এলুইন তার আদিবাসী জগত বইয়ে লিখেছেন, “পাহাড় ও সমতলের ঐক্য জাতীয় স্বার্থেও যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন পাহাড় ও অরণ্যের মানুষদের স্বার্থে। আমরা পরস্পরকে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় করতে পারি। আদিবাসীদের আমরা অনেক কিছু দিতে পারি, আবার ওদেরও অনেক কিছু আছে, যা আমাদের দেবার মতো।”

সমতলের আদিবাসীরা কী কী কারণে ভূমি হারায়
দেশভাগের কারণে (১৯৪৭) হিন্দুদের কী অবস্থা হয়েছে, এ নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে। কিন্তু আদিবাসীদের জীবনে দেশভাগের ফলে কী ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল, এ নিয়ে খুব একটা কাজ হয় নি। মূলত: ১৯৪৭ ছিল আদিবাসী জীবনেও বড় টার্নিং পয়েন্ট। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালের হামলা ও আক্রমণ (রায়ট নয়)। হামলা হয়েছিল একপক্ষ, অন্যপক্ষ আদিবাসীরা শুধু পলায়ন করেছে, দেশান্তরিত হয়েছে। (দেুখুন: রেভা: ই গেডার্টের বই গারো অঞ্চলে ক্যাথলিক মিশনারীগণ)। আর ১৯৬৫ সালের মাত্র ১৭ দিনব্যাপী পাক-ভারত ‍যুদ্ধের ফলে আদিবাসীদের অনেক জমি শত্রু সম্পত্তি হয়ে গেছে।

  • পপুলেশন ট্রান্সফার বার বার বাধ্যতামূলক দেশান্তকরণ প্রক্রিয়া, ১৯৪৭ সালের পর থেকে গারো, হাজং, কোচ, ডালু, হদি, বানাই প্রভৃতি আদিবাসীদের কয়েকদফা প্রাণরক্ষার জন্য জন্মভূমি ছাড়তে হয়। ১৯৬৪ সালে পাক সরকার সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চালায়। তখন আদিবাসীরা দেশত্যাগে বাধ্য হয়। তাদের ফেলে যাওয়া জমিতে সরকার অআদিবাসীদের পুনর্বাসিত করে। যারা ফিরে আসে, পরবর্তীতে তাদের মধ্যেও অনেকে জমি ফেরত পায়নি। ১৯৭১ সালেও আদিবাসীদের সবকিছু  ত্যাগ করে দেশান্তরিত হতে হয়। গারো অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় ১৯৭৫ সালেও গারোদের অনেকে দেশান্তর হয়। বার বার দেশান্তরের ফলে তাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। 
  • আদিবাসীদের কোনো মতামত বা সম্মতি ছাড়াই আদিবাসীদের ভূমিতে ও এলকায় জাতীয় উদ্যান, ইকো-পার্ক নির্মান, গাজনী অবকাশ কেন্দ্র, সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ।
  • আদিবাসীদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত, ব্যবহৃত ভূমিকে আদিবাসীদের না জানিয়েই রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণা বা খাস করে দেয়া
  • উচ্ছেদ নোটিশ বা শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে আদিবাসীদের হয়রানি ও শেষ করে দেয়া
  • শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি আইন
  • ভূমিলোভী চক্রের জাল দলিল, জোরপূর্বক জমি দখল
  • জমি-জমা সংক্রান্ত আইন কানুন, খারিজ, খাজনা, কাগজপত্র তৈরী ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতার অভাব
  • প্রজাসত্ত্ব আইন ১৯৫০ বলবৎ থাকার পরও এর যথাযথ  বাস্তবায়ন না হওয়া এবং জেলা প্রশাসনে কোন আদিবাসী বিষয়ক অফিসার না থাকা (পূর্বে এটি ছিল)
  • সরকারি ভূমি অফিসের দুর্নীতি ও ঘুষ দিতে বাধ্য করা; ঘুষ না দিলে জমি খাস করে দেয়া
  • আইনের আশ্রয় না পাওয়া, এমনকি মামলায় জয়ী হলেও জমির দখল বুঝে না পাওয়া
  • বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ মামলা চালাতে গিয়ে আরও জমিজমা হারানো, নিঃস্ব ও সর্বশান্ত হওয়া

No comments:

Post a Comment

আদিবাসী, ভূমি ও জীবন

আদিবাসীদের কাছে ভূমিই জীবন, ভূমিই অস্তিত্ব। আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কিছু বলার আগে, সম্পদ, ভূমি, বন, প্রাণী জগত, ধরিত্রী ও অধিকার সম্পর্কে আদ...